কবিতার ব্যাখ্যাঃ ঐকতান

শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে রাখি।যেগুলো প্রায়ই তোমাদের ভালোভাবে জানা দরকার। রবীন্দ্রনাথের লেখা কাব্যগ্রন্থ - ৫৬টি, উপন্যাস- ১২টি, নাটক- ২৯টি, গল্পগ্রন্থ - ৩টি (গল্পগুচ্ছ, গল্পসল্প, গল্পসপ্তক), বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা- বিশ্বপরিচয়, ছোটগল্প১১৯, গান- ২২৩২ [বিতর্কিত],আঁকাছবি- প্রায়২০০০, ভ্রমণকাহিনী - ৯টি,

এখন শুরু হবে, লাইন বাই লাইন এক্সপ্লেনেশন

 

বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।

দেশেদেশে কত-না নগর রাজধানী-

মানুষের কত কীর্তি, কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,

কত-না অজানা জীব, কত-না অপরিচিত তরু

রয়ে গেল অগোচরে।

 

ব্যাখা:- এই পৃথিবী বিশাল এবং বিপুল আয়তনের। এখানে জানার মত কত্তকিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু তার কতটুকুই বা জানি! দেশেদেশে কতই না শহর-রাজধানী আছে।মানুষের কত কীর্তি, নদী, গিরি (পাহাড়), সিন্ধু (সাগর), মরু (মরুভুমি) ইনা আছেএই বিশালাকার পৃথিবীতে! কতঅজানা জীব, অপরিচিত গাছপালা এখনো আমার জানার বাহিরেই রয়ে গেল।আমি তার সান্নিধ্যও পেলাম না।

 

বিশাল বিশ্বের আয়োজন;

মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।

সেই ক্ষোভে পড়িগ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে

অক্ষয় উৎসাহে

 

ব্যাখা: এ বিশ্বের আয়োজন বিশাল।কিসের আয়োজন! জানার/জ্ঞান আহরণ করার আয়োজন।কিন্তু, কবির মন তারই ক্ষুদ্র এক কোণ জুড়ে থাকে। অর্থাৎ, কবি এখানে তার জানার সীমাবদ্ধতাটুকু অকপটে প্রকাশ করেছেন।কবি,  সেইক্ষোভে, অর্থাৎজানার সীমাবদ্ধতার ক্ষোভেবই পড়েন।ভ্রমণকাহিনী পড়েন।অর্থাৎ, কবি হয়ত সকলদেশ, সকল রাজধানী, সকল অজানা কিছু জানতে পারেননি। এটা তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু, তিনি তার সীমাবদ্ধতা টুকু দূর  করার জন্য বই বা ভ্রমণকাহিনী পড়ছেন।যাতে করে, সমস্ত দেশ বা নগর না ঘুরলে ও যাতে কবি সব  জায়গা থেকে কিছু হলেও জ্ঞানার্জন করতে পারেন।

 

যেথা পাই চিত্র ময়ী বর্ণনার বাণী

কুড়াইয়া আনি।

জ্ঞানেরদীনতা এই আপনার মনে

পূরণ করিয়া লই যত পারিভিক্ষালব্ধ ধনে।

 

ব্যাখা: একটা প্রবাদ আছে। Pictures say thousand words! অর্থাৎ, কোনো কিছুর সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ জানার জন্য, তুমি যদি খালি গৎবাধা লেখা পড়ো, তাহলে তোমার জানাটা স্বল্পস্থায়ী হবে। কিন্তু, বর্ণনাটা যদি চিত্রময়ী হয়, বা যদি ছবির মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়, তবে সেই জানাটা তোমার মনে দাগ কেটে যাবে। কবি এই চিত্রময়ী বর্ণনা গুলোকে ইকুড়িয়ে আনেন। কবি আরো বলেছেন, তার জ্ঞানের দীনতা আছে। অর্থাৎ, তিনি জ্ঞানের দিক থেকে গরীব।কিন্তু, তারপরও তিনি বিভিন্ন সূত্র থেকে জ্ঞান আহরণ করে তার জ্ঞান ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেন।

 

আমি পৃথিবীর কবি, যেথা তার যত উঠে ধ্বনি

আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি,

 

ব্যাখা: কবিনিজেকেপৃথিবীরকবিহিসেবেঘোষিতকরেছেন।এবংবলেছেন, মানুষেরাপৃথিবীরযেপ্রান্তেইথাকুকনাকেন, কবিরবাঁশিরসুর [এখানে, কবিতারসুর] সর্বত্রইসাড়াপ্রদানকরবে।

 

এই স্বরসাধনায় পৌঁছিলনা বহুতর ডাক -

রয়ে গেছে ফাঁক।

 

ব্যাখা: অর্থাৎ, কবির কবিতার সূর সর্বত্র পৌঁছাতে পারেনি।কবির চাওয়া, এবং তার কবিতার সুর প্রান্তিক মানুষের পাওয়ার মধ্যে এখনো বিস্তর ব্যবধান বা ফারা করয়েই গেছে।

 

প্রকৃতিরঐকতানস্রোতে

নানাকবিঢালেগাননানাদিকহতে

 

ব্যাখা: রবি ঠাকুর বলেছেন, তার মতই আরো  অনেক কবি, বিভিন্ন দিক থেকে কবিতা রচনা করে।এবং সেই কবিতার সূর গুলো পৌঁছে দিতে চায় মানুষদের কাছে।

 

তাদের সবার সাথে আছে মোর এইমাত্র যোগ-

সঙ্গ পাই সবাকার, লাভ করি আনন্দের ভোগ,

 

ব্যাখা: অর্থাৎ, ঐ সকল কবির সাথেই রবিঠাকুর এর যোগাযোগ রয়েছে। এবং তাদের সবার সঙ্গ পেয়ে কবিব রং আনন্দিত ইহন।

 

পাইনে সর্বত্র তার প্রবেশের দ্বার,

বাধা হয়ে আছে মোর বেড়া গুলি জীবনযাত্রার।

 

ব্যাখা: অর্থাৎ, রবিঠাকুর চাইলেও সেই সকল কবির সাথে মিশতে পারেন না। কেননা, কবি গুরুর জীবনযাত্রা আর তাদের জীবন যাত্রায় যে এখন ও ব্যবধান! এখানে খুব সম্ভবত ধনী-গরীব শ্রেণীর ব্যবধান এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।

 

চাষি খেতে চালাইছে হাল,

তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল-

বহু দূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার

তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।

 

ব্যাখা: এখানে কবি, সমাজের প্রান্তিক/শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর পেশাকে মর্যাদা দিয়েছেন।এবং বলেছেন, তাদের কাজের উপর নির্ভর করেই সংসার এগিয়ে যাচ্ছে।

 

অতি ক্ষুদ্র অংশে তার সম্মানের চিরনির্বাসনে

সমাজের উচ্চমঞ্চে বসেছি সংকীর্ণ বাতায়নে।

 

ব্যাখা: কবি এখানে বলেছেন, তিনি সমাজের উচ্চ মঞ্চে আসন গ্রহন করেছেন।এবং সাধারণ,  প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছেন।ফলে, সেই উঁচু মঞ্চের সংকীর্ণ জানালা দিয়ে সাধারণ মানুষদের এ বড় সমাজটিকে তিনি দেখতে পারেন নি।

 

মাঝে মাঝে গেছি আমিও পাড়ার প্রাঙ্গণের ধারে,

ভিতরে প্রবেশ করি সেশক্তি ছিল না একে বারে।

 

ব্যাখা: কবি মাঝে মাঝে ঐ সকল সাধারণ শ্রম জীবী জনগোষ্ঠীর পাড়ায় উঁকি দিয়েছেন। কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাদের সাথে ভালো ভাবে যোগসূত্র রচনা করতে পারেননি।

 

জীবনে জীবন যোগ করা

না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা।

 

ব্যাখা: কবির কবিতা যদি জীবনের সাথে জীবনই যোগ করতে না পারে, অর্থাৎ ধনী-গরীব/উচ্চশ্রেনী-নিম্ন

শ্রেনীর মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধ নই তৈরি করতে নাপারে, তবে সেই কবিতা মূল্যহীন। এসব প্রান্তিক মানুষকে শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনে যোগ্যস্থান দিলেই কেবল সাহিত্য সাধনা পূর্ণতা পায়।

 

তাই আমি মেনে নিলাম সে নিন্দার কথা

আমার সূরের অপূর্ণতা।

আমার কবিতা, জানি আমি,

গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্র গামী।

 

ব্যাখা: কবি নিজের সীমাবদ্ধতা টুকু মেনে নিলেন।অনেকেই কবির নামে নিন্দে করত, যে তিনি শুধু বাবু সাহেবদের কেনিয়েই সাহিত্য রচনা করেন।কবি সেই নিন্দেটুকুও মেনে নিলেন।কবি নিজেই জানেন,  তার কবিতা বিচিত্র পথে গেলেও সর্বত্র পৌঁছাতে পারেনি।

 

কৃষাণের জীবনের শরিকযে জন,

কর্মেও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,

 

ব্যাখা: কৃষকের জীবনের মত জীবন যে অতিবাহিত করতে পারছে, সে সত্যিই কথায়ও কাজে আত্মীয়তা অর্জন করতে পেরেছে।

আত্মীয়তা ?কাদের সাথে আত্মীয়তা?

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে।

 

এসো কবি অখ্যাত জনের

নির্বাক্মনের।

মর্মের বেদনা যত করিয়া উদ্ধার-

 

ব্যাখা: বিখ্যাত শব্দে রবি পরীত হল অখ্যাত।এখানে, রবিঠাকুর এমন কবিকে আহবান করছেন, যিনি এসব অখ্যাত মানুষদের জীবনকে আবিষ্কার করতে পারবেন।অর্থাৎ, সাধারণ কর্মজীবী মানুষদের জীবনকে কবিতার দ্বারা তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে।পাশা পাশি, কবি গুরুর কবিতা সর্বত্র গামী না হওয়ার যে ব্যাথা, সেই মর্মের ব্যাথা উদ্ধার করার জন্য তিনি নতুন কবিকে আহবান করেছেন।

 

প্রাণহীন এদেশেতে গানহীন যেথা চারিধার,

অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভুমি

রসে পূর্ণ করিদাও তুমি।

 

ব্যাখা: কবি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন, যে সাহিত্যের ভুবন আনন্দহীন মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।কারণ, সমাজের শ্রমজীবী মানুষেরা সাহিত্য সভায় উপেক্ষিত। তারা সাহিত্যেস্থান পায়নি। এজন্য কবি আহবান করেছেন নতুন আরেক কবিকে, যিনি এসব শ্রমজীবী মানুষদের স্থানদিবেন সাহিত্যের ভুবনে। এবং সাহিত্য ভুবন এর উষরতা (শুষ্কতা) কেরসে পূর্ণ করে দিবেন।

 

অন্তরে যে উৎসতার আছে আপনারি

তাই তুমি দাও গো উদবারি।

 

ব্যাখা: উদবারি মানে হল, উপরে বাউর্ধ্বে প্রকাশ করা।কবি বলছেন, হে নতুন কবি, তোমার অন্তরে যে রসের উৎস আছে, তা উন্মুক্ত করে দাও।

 

সাহিত্যের ঐকতান সংগীত সভায়

একতারা যাহাদের তারাও যেন সম্মান পায়

 

ব্যাখা: অর্থাৎ, সাহিত্যের সভায়, যেখানে জীবনের সূর যোগ করা হয়, সেখানে যেন অবজ্ঞাত বা উপেক্ষিত মানুষেরাও সম্মান লাভ করে।

 

মূক যা রাদু:খেসুখে,

নতশির স্তব্ধ যারা বিশ্বের সম্মুখে,

ওগো গুণী,

কাছে থেকে দূরে যারা তাহাদের বাণী যেন শুনি।

 

ব্যাখা: কবি বলেছেন, তিনি সেসব লোকেদের বাণীশুন তেচান, যারা কাছে থেকেও দূরে।যারা দু:-সুখ সহ্য করা নির্বাক মানুষ।যারা এগিয়ে চলাপৃথিবীতে এখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনা।


Post a Comment

0 Comments